‘প্লাটিপাস’ অস্ট্রেলিয়ার রহস্যময় প্রাণী!

প্লাটিপাস (Platypus) পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত এবং রহস্যময় প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এটি অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা শারীরিক গঠন এবং বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত। বিজ্ঞানীরা প্রথমে প্লাটিপাসের অস্তিত্ব জানার পর বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ এর শরীরের বৈশিষ্ট্য একেবারে অদ্ভুত, যা অন্যান্য প্রাণী থেকে একেবারে আলাদা। প্লাটিপাসের রহস্যময় জীবন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া জানলে আপনি অবাক হবেন। আসুন, একে একে জানি প্লাটিপাসের সব কিছু।


প্লাটিপাসের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য

প্লাটিপাস এক ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে। এর শরীরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এটি অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে একেবারে আলাদা করে তোলে। প্রথম নজরে দেখে মনে হবে, এটি একটি বিচিত্র প্রাণী যা হাঁস, বিড়াল, এবং কুমিরের মিশ্রণ। এর শরীরের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:

হাঁসের মতো ঠোঁট

প্লাটিপাসের মুখে হাঁসের মতো প্রশস্ত ও নরম ঠোঁট রয়েছে। এর এই ঠোঁটটি আসলে একটি বিশেষ অঙ্গ, যা খাবার খোঁজার জন্য ব্যবহৃত হয়। ঠোঁটের মধ্যে থাকা স্নায়ু সিস্টেম প্লাটিপাসকে পানির নিচে খাদ্য খোঁজার সময় সহায়তা করে। এটি কোনো খাবার যদি পানির নিচে থাকে, তবে এটির মাধ্যমে প্লাটিপাস অত্যন্ত দ্রুত তা শিকার করতে পারে।

বিশেষ পা

প্লাটিপাসের পা দেখতে অনেকটা বিড়ালের মতো হলেও এর পায়ের পাতাগুলি বেশ প্রশস্ত। এটি প্লাটিপাসকে পানিতে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। এর পায়ের পাতা এমনভাবে তৈরি যে, প্লাটিপাস পানির মধ্যে দ্রুত চলাচল করতে পারে। পুরুষ প্লাটিপাসের পায়ে বিশেষ বিষাক্ত কাঁটা রয়েছে, যা সে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করে।

কুমিরের মতো লেজ

প্লাটিপাসের লেজ অনেকটা কুমিরের মতো দেখতে, যা এটি পানি থেকে বের হয়ে আবার পানিতে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে। এটি প্লাটিপাসের সাঁতারের গতি বাড়ানোর কাজও করে।


প্লাটিপাসের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস

প্লাটিপাস মূলত জলজ প্রাণী এবং এটি এক ধরনের আধা-জলজ জীবনযাপন করে। এটি দিনের বেলা প্রায় নিস্তেজ অবস্থায় থাকে এবং রাতের বেলা শিকার করতে বের হয়। নিচে এর জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

খাদ্যাভ্যাস

প্লাটিপাস সাধারণত ছোট মাছ, কাঁকড়া, জলজ পোকামাকড় এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী খায়। এটি পানির নিচে সাঁতার কাটতে গিয়ে খাবার খোঁজে এবং তার বিলের মাধ্যমে খাবার শোষণ করে। প্লাটিপাসের বিলটি পানির নিচে শত শত স্নায়ু দ্বারা সজ্জিত, যা তাকে খুব সূক্ষ্মভাবে খাবার খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।

শিকারী জীবন

প্লাটিপাস রাতের বেলা শিকারী প্রাণী হয়ে ওঠে। এটি পানিতে ডুব দিয়ে এবং পা দিয়ে খাদ্য খোঁজে। প্লাটিপাস পানির মধ্যে কোনো খাবার খুঁজে না পেলে, এটি মাটি বা পাথরের নীচে গিয়ে খোঁজে এবং পায়ে চাপ দিয়ে পানির স্তর পরীক্ষা করে।

পানির নিচে থাকা সময়

প্লাটিপাস এক সময় একসাথে ২ মিনিটের মতো পানি নিচে থাকতে পারে। কিন্তু একে একে এটি যতটা সম্ভব খোলামেলা জায়গায় চলে আসে, যতটা সময় তার শ্বাস নিতে দরকার হয়।


প্লাটিপাসের প্রজনন প্রক্রিয়া

প্লাটিপাসের প্রজনন প্রক্রিয়া অত্যন্ত বিশেষ। পৃথিবীর কয়েকটি স্তন্যপায়ী প্রাণীই ডিম দেয়, তবে প্লাটিপাস এমন এক প্রাণী যা ডিম পাড়ে। এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

ডিম দেওয়ার রহস্য

প্লাটিপাসের মা যখন ডিম পাড়ে, তখন তা মাটির নিচে সুরক্ষিত থাকে। প্লাটিপাসের ডিমের শেলের গঠনও অন্য স্তন্যপায়ীদের থেকে আলাদা। মা প্লাটিপাস তার ডিমকে ১০ দিনের মতো তাপ দিয়ে তা ফোটানোর চেষ্টা করে। একবার ডিম ফুটে বের হলে, বাচ্চাগুলি স্তন্যপান শুরু করে এবং মায়ের কাছ থেকে শোষণ করা দুধ খায়।

পুরুষ প্লাটিপাসের কার্যকলাপ

প্লাটিপাসের পুরুষ যখন প্রজননকালীন সময় আসে, তখন এটি নিজের কাঁটাগুলির মাধ্যমে শত্রুদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে এবং তার সঙ্গীকে আকর্ষণ করতে শক্তি দিয়ে সাঁতার কাটে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রজনন চক্রের সময় পুরুষটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।


প্লাটিপাসের পরিবেশে ভূমিকা

প্লাটিপাসের পরিবেশে ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছোট জলজ প্রাণী, মাছ এবং পোকামাকড়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে, যা প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। প্লাটিপাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, প্রতিটি প্রাণী তার পরিবেশে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে।


প্লাটিপাসের ভবিষ্যত এবং সংরক্ষণ

আজকের দিনে, প্লাটিপাস বেশ কিছু পরিবেশগত বিপদের সম্মুখীন। জলাশয়ের দূষণ, বন্যপ্রাণী শিকার, এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্লাটিপাসের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারে, যদি এর সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা প্লাটিপাসের বাসস্থান ও প্রজনন স্থান সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *